ঢাকা, ১৬ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার, ২০২৫ || ৩ মাঘ ১৪৩১
good-food
৭৩১

মক্কা নগরীকে যেমন জানলাম এবং একটি স্বপ্নের গল্প 

মেজর ডা. খোশরোজ সামাদ

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ১৩:৪৩ ১৭ আগস্ট ২০১৯  

১. পবিত্র হজ্জব্রত পালন করতে আসা সন্মানিত ব্যক্তিবর্গদের চিকিৎসা সেবা দিতে হজ্জ মেডিকেল টিমের সদস্য হিসেবে মক্কায় এসেছি। সদাশয় সরকারের সানুগ্রহে ওমরাহ ও হজ্জব্রত পালন করেছি। হজ্জের সকল আনুষ্ঠানিকতা শেষে বর্তমানে মদিনাতে অবস্থান করছি।

২. বাংলাদেশের প্রায় দেড়লাখ হাজিসহ তামাম দুনিয়ার প্রায় ত্রিশ লাখ পূণ্যবান মক্কায় এসেছিলেন। একসাথে এত মানুষের একটি নগরীতে প্রায় একসাথে প্রবেশ সারা পৃথিবীতে একমাত্র মক্কা নগরীতেই হয়।

৩. সৌদি আরবের অন্যান্য নগরী, নিকটস্থ আফ্রিকার দরিদ্র দেশ, আমেরিকা ইউরোপের বিভিন্ন ধনাঢ্য দেশ, রাশিয়া-চীনের মত সমাজতান্ত্রিক দেশসহ দুনিয়ার প্রায় সকল দেশ থেকে হাজিরা এসেছেন।

৪. বিমান, বাস - কোচ পায়ে হেঁটে হাজিরা হারাম শরীফে এসেছেন। হাজার হাজার বিমানের আকাশে ওঠানামা নেভিগেশন 'কোলাপ্স হওয়ার আশংকাকে' তুড়ি মেরে সৌদি ইমিগ্রেশন অত্যন্ত সফলতার সাথে যুগোপযোগী প্রযুক্তি ব্যবহার করে শুধু উচ্চ শিক্ষিতই নয়, পুরোপুরি নিরক্ষর / অল্প - অর্ধ - শিক্ষিত হাজিকে সময়ানুবর্তিতার সাথে বিমানবন্দর থেকে গন্তব্যে নির্গমণ করাতে পেরেছেন।

৫. এই ত্রিশ লাখ ব্যক্তির প্রথম এবং একমাত্র লক্ষ্য হজ্জব্রত পালনই হলেও কিছু সংখ্যক পথভ্রষ্ট - বিভ্রান্তদের জংগী হামলার আশংকাকে, আন্তর্জাতিক কোন কূটচালের ষড়যন্ত্রকে মোকাবেলা করা হয়েছে অত্যন্ত দক্ষতা আর মেধাদীপ্তির সাথে। পুলিশ,প্যা রামিলিশিয়াসহ সামরিকবাহিনী নিয়মিত বিভিন্ন স্তরে দায়িত্ব পালন করেছেন। মাথার ওপর টহল হেলিকপ্টার দেখা গেছে। দিনমান ২৪ ঘন্টায় নারীপুরুষ বিভিন্ন সড়কে যাতায়াত করলেও কোন ছিনতাই, নারীর প্রতি যথাযত সন্মান প্রদর্শন না করবার কোন খবর পাওয়া যায় নি।

৬. আসওয়াদে কালো পাথরে চুম্বন, শয়তানকে কংকর মারবার সময় অতি উৎসাহীদের চাপে দুর্ঘটনা এমন কি মৃত্যুবরণ করবার অতীত ইতিহাস থেকে সৌদি কর্তৃপক্ষ ফলপ্রসূ এবং বাস্তবমুখী পদক্ষেপ নেয়ায় এই বিষয়ে দুর্ঘটনার কোন বড় খবর আসে নি।

৭. এত ব্যাপক সংখ্যক হাজীর বিভিন্ন দেশীয় খাবার জোগানোর মত সংবেদনশীল কাজেও নৈপুণ্যের ছাপ ছিল। সৌদী সরকার, দেশী - বিদেশী প্রতিষ্ঠান, ধনাঢ্য ব্যক্তিরা রাস্তার মোড়ে মোড়ে বিনামূল্যে পানি, জুস, হালকা ও ভারী খাবার পরিবেশন করেছেন। হাজিরা খাবার সময় পাশের জনের সাথে খাবার ভাগ করে নিয়েছেন পরম মমতায়।

৮. মরুর দেশে তাপমাত্রা ৪৮ ডিগ্রী সেলসিয়াস নৈমিত্তিক ঘটনা। যে সব এলাকায় বেশী লোক সমাবেশ হয় সেখানে ঠান্ডা পানি ছিটানোতে হিটস্ট্রোক কমানো গেছে। পুরো হারাম শরীফকে অত্যাধুনিক শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় এনে বয়সী ও রোগাক্রান্ত হাজীদের জন্য হজব্রত পালনের মত বিপুল শ্রমযুক্ত বিষয়টি অনেকটি সহনীয় করা গেছে।

৯. এই বিপুল সংখ্যক হাজীর পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থাও  নিয়ন্ত্রণযোগ্য। টয়লেটের সামনে অসীম ধৈর্য্য নিয়ে বয়সী হাজিরা অপেক্ষা করেছেন।

১০. সক্ষম হাজিরা পাঁচ তারকা হোটেল থেকে বিভিন্ন আবাসনে এমন কি খোলা ময়দানে অপেক্ষাকৃত অসচ্ছল হাজিরা রাত কাটিয়েছেন। স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দিকে বিশেষ নজর ছিল। বাংলাদেশসহ প্রায় সকল দেশেরই হজ্জ মেডিকেল টিম স্বাস্থ্য সেবা দিয়েছে। বিশেষ প্রয়োজনে কিং ফয়সলের মত অত্যাধুনিক হাসপাতালে চিকিৎসা দেবা বিনামূল্যে দেয়া হয়েছে। প্রতিবারের মত এবারেও মৃত্যুগুলি মূলত বার্ধক্যজনিত ও অনিরাময়যোগ্য অসুস্থতার কারণে হয়েছে।

১১. দ্রব্যমূল্য আরও সহনশীল হলে ভাল হত। পরিবহন খাতে, ইন্টারনেটের খরচ অনেকের জন্য কষ্টসাধ্য ছিল। প্রত্যাশিত যে, আরবীয়রা ইংরেজিতে আরও পারদর্শী হবেন।

১২. যে শিক্ষায় মানুষ মাতৃভূমিকে পূণ্যভূমি মনে করে সে শিক্ষায় আমি বড় হয়ে উঠেছি। আমি স্বপ্ন দেখি আমার জন্মভূমিও পূণ্যভূমির মত পবিত্র, সুন্দর। কেন হজ্জব্রতর মত বিশাল আয়োজন সফল হয় তা নিয়ে আমি আমার সীমিত মেধায় অনেক ভেবেছি। মূল ছিল স্রষ্টার প্রতি নিরংকুশ আনুগত্য। নিজদেশও তো মাতৃস্থানীয় বলেই শিশুশিক্ষার বই থেকে জেনে এসেছি । আমরা যদি আনুগত্য নিজদেশের প্রতি দেখাই তবে আমার ধারণা, পরম স্রষ্টা অখুশী হবেন না। অস্থিরতার বদলে অপরিসীম ধৈর্য ধারণ করে তাওয়াফসহ বিভিন্ন উপাচার পালন খাবার, পরিবহন, সবাস্থ্যসেবার লম্বা ' কিউ' হাসি ও প্রত্যয়দীপ্ত মুখে করেছে সেই চর্চা প্রতি বছর যে কয়জন হাজী করেছেন, সেই কয়জন বাংলাদেশে ফিরে নিজের ব্যক্তিজীবনে পালন ও নিকটজনকে ' পালনের চেইন'- এ নিয়ে আসলেই অল্প কবছর পরই বাংলাদেশকে অনেকটাই পুণ্যভূমির মত সাজানো সম্ভব। কিভাবে সম্ভব? নজরুল বলেছিলেন -
' মিথ্যা শুনি নি ভাই, 
এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোন মন্দির কাবা নাই'

সেই হৃদয় বন্দরে শৃংখলা, প্রেম, একাগ্রতা, ধৈর্য্য আর নিয়মের প্রতি শ্রদ্ধাশীলতা দিয়ে পুর্ণ করা হলেই হাজার অলি আউলিয়ার পদচিহ্ন বাংলা নামের ব দ্বীপটিও একদিন পূণ্যভূমি হয়ে উঠবে।

ধর্ম বিভাগের পাঠকপ্রিয় খবর